বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় নয়া ফসল: কাসাভা

বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় নয়া ফসল: কাসাভা

কাসাভা হলো উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের আলুজাতীয় ফসল যা পৃথিবীর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় । কাসাভা বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। গ্রামের মানুষ কাসাভার কন্দকে শিমুল আলু বলে। গাছটির পাতা অনেকটা শিমুল গাছের মতো দেখতে বলেই হয়তো এরকম নামকরণ।রোগজীবানু ও পোকামাকড়ের আক্রমন প্রতিরোধি এ ফসল সহজেই অনুর্বর জমি ও খরা প্রবন এলাকায় চাষ করা যায় ।

পুষ্টিগুনঃ  কাসাভায় সাধারনভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা , ১-২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান । আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুনেরও বেশী শর্করা থাকায় ইহা আলুর চেয়ে আনেক বেশী পুষ্টিকর । যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শর্করার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসাবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শর্করার ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসাবে থাকে । এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন সি উল্লেখযোগ্য পরিমানে পাওয়া যায় ।

জাত: কাসাভার অনেকগুলো প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে । কৃষকরা খাবার ও বানিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকে । খাবারের জন্য অনেক অঞ্চলে মিষ্টি জাতের কাসাভা চাষ করা হয় । ভারতে কাসাভার জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো M-4, H-97, H-165,H-226, H-1687, H-2304 I S-856। ইন্দোনেশিয়ায় ADIRA-1,2,3,4 থাইল্যান্ডে RAYONG-1,2,3,60 ফিলিপাইনে PR-C 13,24,62 এবং চীনে SC-201,205,124জাতগুলো জনপ্রিয় । নাইজেরিয়ায় TMS-3001,30572,50395,30555এবং কলম্বিয়ায় M.Col.-2215,1684, M.BRA-5,12 জাতগুলো উল্লেখযোগ্য ।

চাষ কৌশলঃ

মাটি: উষ্ণ ও নাতিষিতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য উপযোগী । অনুর্বর পাহাড়ী মাটি কিংবা বালি মাটি যেখানে অন্য কোন ফসল ফলানো যায় না সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায় । তবে এ ফসল জলাবদ্ধতা ও উচ্চ লবনাক্ততা সহ্য করতে পারে না ।

জলবায়ু: এটি একটি খরা সহনশীল ফসল । যেখানে ৬ মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা সহজে চাষ করা যায় । তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রীর সেন্টিগ্রেডের নিচে কাসাভা ভালো হয় না । উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । সমুদ্রপৃষ্ট হতে ২৩০০ মিটার উপরেও কাসাভা চাষ করা যায় ।

বংশবৃদ্ধি: গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিংবা কাটিং উভয়ই ব্যবহার করা যায় । বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ক কান্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয় । কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ্য সবল ও রোগমুক্ত কান্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছর লাগানোর জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষন করতে হয় । লাগানোর সময় কান্ডকে ১৫-২০ সেমি করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে । প্রতিটি কাটিং এ কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টা নোড থাকতে হবে ।

জমি তৈরি: সাধারনত জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না । তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। অধিকাংশ জায়গায় পিট তৌরি করে কাসাভার কাটিং বা সেট লাগানো হয় । পাহাড়ী এলাকায় এটি একটি সহজ ও সুবিধাজনক পদ্ধতি । তবে পিটগুলো মাটি থেকে একটু উপরের দিকে উঠানো হলে ফলন ভালো পাওয়া যায় ।

লাগানোর নিয়ম: প্রতি হেক্টর জমিতে ১০,০০০ গাছ লাগানো যায় । একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরুত্ব ৭৫ থেকে ৯০ সেমি রাখতে হবে । কাটিং মাটিতে লাগানোর সময় ২০ সেমি মাটির নিচে এবং ৫ সেমি মাটির উপরে থাকতে হবে । সাধারনত ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাটিং থেকে নতুন কুশি বের হয় । যেসব কাটিং থেকে কুশি বের হবে না সেগুলো তুলে ফেলে সেখানে ৪০ সেমি আকারের নতুন কাটিং লাগাতে হবে ।

লাগানোর সময়: সারা বছরই গাছ লাগানো যায় । তবে সাধারনত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো । আমাদের দেশে এপ্রিল – মে মাস কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ।

সার ব্যবস্থাপনা: তেমন কোন সার প্রয়োগ করতে হয় না । তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস এবং ১৪০-১৬০ কেজি পটাসিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায় ।

সেচ: সাধারনত সেচের প্রয়োজন হয়না । তবে কাটিং লাগানোর পর গাছ গজানোর জন্য ৩-৫ দিন অন্তর অন্তর কমপক্ষে ২ বার সেচ দিতে হবে । দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এতে ফলন বৃদ্ধি পায় ।

আন্তঃপরিচর্যা: গাছ লাগানোর পর এক মাস অন্তর অন্তর গোড়ার আগাছা পরিস্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায় । যদিও কাসাভায় রোগবালাই ও পোকামকড়ের আক্রমন খুবই কম তথাপিও এক ধরনের মাকড়ের আক্রমনে অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে । সবসময় রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত কাটিং লাগাতে হবে এবং মাকড়ের আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে আক্রমন দেখা দেবার সাথে সাথে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে । অনেকসময় ইঁদুর মাটির নিচের কাসাভা খেয়ে বেশ ক্ষতি সাধন করে থাকে । এজন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে ।

ফলন: সাধারনত হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায় । তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাত চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায় ।

গুদামজাতকরন: গুদামজাতকরনের সীমাবদ্ধতা কাসাভা উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা । শরীরবৃত্তিয় ও অনুজীবিয় পরিবর্তন এবং বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমনের কারনে দ্রুত পচনশীল কাসাভা সাধারনত গুদামজাত করে সংরক্ষন করা যায় না । তবে উত্তোলন না করে গাছসহ মাটির নিচে রেখে দিলে কাসাভা নষ্ট হয় না । এজন্য কৃষককে তার প্রয়োজনমতো জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করতে হবে এবং সংগ্রহের কয়েক দিনের ভিতরই ব্যবহার কিংব প্রক্রিয়াজাত করতে হবে । আফ্রিকাতে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মতো ধীরে ধীরে জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করে । অথবা কাসাভা সংগ্রহের পর টুকরো টুকরো করে রোধে শুকিয়ে সংরক্ষন করে থাকে । স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কাসাভা সংগ্রহের কয়েকদিনের ভিতরই কারখানায় প্রেরন করতে হয় । তবে আদ্র বালি কিংবা আদ্র কাঠের গুড়ার উপর কাসাভা রেখে দিয়ে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায় । সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা যায়, ০.৪% থায়োবেনডাজল দ্বারা কাসাভা আলু শোধন করে পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষন করলে কাসাভা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে ।

মূল লেখকঃ আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেকৃবি,