মুখীকচু উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল

মুখীকচু উৎপাদনের উন্নত কলাকৌশল

মুখী কচু বাংলাদশে গুড়া কচু, কুড়ি কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বন্নি কচু, ইত্যাদি নামে ও পরচিতি। এটি খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ শ্বেতসার, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস এবং ভিটামিন এ ও সি আছে । মুখীকচুর স্টার্চের হজম যোগ ̈তা বেশী বিধায় এর স্টার্চ শিশু খাদ ̈হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মুখীকচু ক্ষারজাতীয় খাদ্য বিধায় অম্ল শুলেও এটি উপকারী। এটি খরিপ মৌসুমে সবজির অভাব পূরণে সাহায্য করে। তবে আশানুরূপ ফলন পেতে উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া মুখীকচু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।

মাটি ও জলবায়ুঃ সারাদিন রোদ পায় এমন স্থানে মুখীকচু জন্মানো উচিৎ।দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি মুখীকচু চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।তবে জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব পদার্থ থাকা উচিত। এ ফসলের জন্য উষ্ণ ওআর্দ্র জলবায়ু প্রয়োজন।

জাতঃ বাংলাদেশে মুখীকচুর অসংখ্য স্থানীয়জাত আছে। তবে আশানুরুপফলন পেতে উচ্চফলনশীল জাতের চাষ করতে হবে। এ উদ্দেশে ̈বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিলাসী নামে মুখীকচুর একটি উচ্চ ফলনশীলজাত উদ্ভাবন করেছে। এর মুখীগুলো খুব মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। এটি পাতার মড়ক রোগে সহজে আক্রান্ত হয়না ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম। সিদ্ধ করলে মুখী সমানভাবে সিদ্ধ হয়। এর মুখী নরম ও সুস্বাদু এবং ক্যালসিয়াম আক্সালেটের পরিমান কম থাকায় খাওয়ার পর গলার ভেতরে চুলকায় না।অতিসম্প্রতি বারি মুখীকচু-২ নামে আরও একটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।

জীবনকালঃ মুখী কচুর জীবনকাল ১৮০-২০০ দিন।

জমি তৈরীঃ মাটির জোঁ থাকা অবস্থায় জমির প্রকারভেদে ৪-৫ টি লম্বা ও আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।বীজ সাধারণত মুখীর ছড়া বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রতিটি বীজের ওজন ১৫-২০ গ্রাম হওয়া বাঞ্চনীয়। প্রতি শতক জমিতে রোপনের জন্য উপরোক্ত ওজনের ২-২.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।

বীজ বপনের সময়ঃ পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে ফাল্গুন মাস (ফেব্রুয়ারি) বীজ বপনের সবচেয়ে ভাল সময়।কিন্তু যদি সে সুযোগ না থাকে তাহলে বৃষ্টিপাতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রথম বৃষ্টিপাতের পরপরই বীজ লাগিয়ে ফেলতে হবে। তবে বৈশাখের পর (এপ্রিলের পর) বীজ লাগালে ফলন কমে যাবে।

বীজ লাগানোর দূরত্বঃ বীজ লাগানোর দুরত্ব নির্ভর করে মাটির গুনাগুনের উপর। সাধারণত৭৫×২৫সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়। যদি মাটির উর্বরতা কম হয় তবে ৬০×২৫সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়।

সার প্রয়োগঃ আশানুরুপ ফলন পেতে হলে বিলাসীর জন্য নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হবে।

 ** গোবর : ৬১ কেজি/শতক, ইউরিয়া : ৬০০গ্রাম /শতক, টিএসপি: ৫০০গ্রাম/শতক, এমওপি: ৭০০গ্রাম/শতক।

 জমি তৈরীর সময় ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সবটুকু সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজাবার ৪০-৪৫দিন ও ৯০-১০০ দিন পর ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

পরিচর্যাঃ ইউরিয়া সার প্রয়োগের পরপরই সারি বরাবর আইল তুলে দিতে হবে। যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশী সেখানে গাছের গোড়া খড়কুটো দিয়ে ঢেকে রাখলে উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া চারা গজানো থেকে শুরু করে ফসল উঠানোর প্রায় এক মাস পূর্ব পর্যন্ত জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

পোকামাকড় ও তার প্রতিকারঃ পোকা মাকড়ের মধ্যে ক্ষুদ্র মাকড়সার (মাইট) ও জাব পোকার আক্রমণ দেখা যায়। প্রতি লিটারপানিতে ২মিলি নিউরন/এডোড্রিন/টর্ক/এডমায়ার বা যে কোন মাইট দমনকারী ঔষধ মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর জমিতে প্রয়োগ করে এ মাকড় দমন করা যায়। কোন কোন সময় প্রভোনিয়া ক্যাটারপিলার দ্বারা আক্রান্ত হতে দেখা যায়। হাতে পিষে অথবা যে কোন সংস্পর্শ ঔষধ মিশিয়ে গাছে প্রয়োগ করলে এই পোকা সহজেই দমন করা যায়।

রোগ বালাই ও তার প্রতিকারঃ কচুতে পাতা পোড়া রোগ ও কান্ড পচাঁ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। পাতা পোড়া রোগ দেখা দেওয়ার সাথেসাথে ডায়থেন এম-৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/লি হারে পানিতে মিশিয়ে ১ মাস অন্তর অন্তর ৩ বারগাছে প্রয়োগ করতে হবে। কান্ড পঁচা রোগ হলে ১-২গ্রাম রিডোমিল/লিঃহারে পানিতে মিশিয়ে গাছেপ্রয়োগ করতে হবে। ঔষধের সাথে কিছু সাবানের গুড়া মিশালে ভাল হয়।

ফসল সংগ্রহ

মুখীকচুর গাছগুলো যখন হলদে হয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে তখনি এই কচু উঠানোর সময়। পরিপক্কতা লাভের পরও প্রয়োজন বোধে ফসল কয়েক মাস ক্ষেতে রেখে দেয়া চলে। এতে প্রায় ৬-৭ মাস সময় লাগে। অবশ ̈আগাম বাজার ধরতে হলে আরো ২-১ মাস আগে মুখীকচু উঠিয়ে বাজারজাত করা যেতে পারে।

ফলনঃ বিলাসী প্রতিটি গাছে ১টি করে গুড়ি কন্দ, ৫-১০ টি গুড়ি কন্দিকা এবং অনেক মুখী উৎপন্ন হয়। মুখীই এর প্রধান ভক্ষণযোগ্য অংশ।প্রতি শতকে ফলন প্রায় ১২০-১৪০ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়।সংরক্ষণ পরবর্তী মৌসুমে বীজ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনমত মুখী না উঠিয়ে মাটিতে রেখে দিলে বীজ ভাল থাকে। বর্তমানে যে পরিমাণ জমিতে কচুর চাষ হচ্ছে তার মাত্র অর্ধেক পরিমান জমিতে বিলাসী জাতের চাষ করে মোট উৎপাদন দ্বিগুন করা সম্ভব।